
‘আমার কাছে মনে হইল ১০ মিনিট আছিলাম।কিন্তু পানির ওপরে উইঠা শুনি,১২-১৩ ঘণ্টা আছিলাম। আল্লাহ যে ক্যামনে ১২-১৩ ঘণ্টা পার কইরা দিল বলতে পারি না।আমি ভেতরে কিসের মধ্যে ছিলাম,কিচ্ছু বুঝতে পারি নাই,তবে পানির তলে ছিলাম এইটুক জানি।’বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ১৩ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার হওয়া সুমন বেপারী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুইয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন।তবে তার কথায় কিছুটা অসংলগ্ন লক্ষ্য করা গেছে। গতকাল তিনি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন,‘লঞ্চ যখন ডোবে, তখন আমি ঘুমাইতেছিলাম।আচমকা ধাক্কায় আমার ঘুম ভাইঙা যায়।হুড়াহুড়ি শুরু হয়।আর কিছু খেয়াল নাই।কিসের মধ্যে ছিলাম আল্লাহ জানেন,তবে ভেতরে এক জায়গায় খাড়ায় ছিলাম রড ধইরা।’রাজধানীর শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরা সুমন বেপারীকে নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।কীভাবে তিনি ডুবে যাওয়া লঞ্চের ভিতর ছিলেন সেটিই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।তবে,শ্বাসরুদ্ধকর ওই ১৩ ঘণ্টার স্পষ্ট বর্ণনা মিলছে না সুমন বেপারীর কাছ থেকে।কখনো বলছেন,১৩ ঘণ্টাই মৃত্যুর প্রতিক্ষায় দোয়া-দরুদ পড়ে কাটিয়েছেন,কখনো বলছেন মাথায় আঘাত পেয়ে পুরো সময়টাই তিনি অচেতন হয়ে ছিলেন,আবার বলছেন একটি রড ধরে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।গতকাল দুপুর ১টার দিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে সুমন বেপারীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।তিনি বলেন,রাজধানীর বাদামতলীর এলাকায় ফল বিক্রি করেন তিনি।সপ্তাহে এক বা দুই দিন গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির আবদুল্লাহপুরে থাকেন।বাকি দিনগুলো সদরঘাটে বিভিন্ন নৌকায় রাত কাটান সুমন।বিয়ে না করলেও মা আমেনা খাতুনের টানেই ঘন ঘন গ্রামে যেতেন।সোমবার সকালে গ্রামের বাড়ি থেকেই প্রতিবেশী আরেক ফল বিক্রেতা মাসুমকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন।কাঠপট্টি থেকে ৪০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে লঞ্চের নিচতলার একটি ছিটে বসেন।চোখে কিছুটা ঘুম ছিল।হঠাৎ করেই দেখতে পান অন্য একটি লঞ্চের ধাক্কায় তাদের লঞ্চটি ডুবে যাচ্ছে।এ সময় তিনি নিচতলাতেই ছিলেন।এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন।তিনি বলেন,‘আমি পানির মধ্যে ডুইবা যাইতে থাকি। কয়েক ঢোক পানিও খাই।এরপর আল্লাহ আস্তে আস্তে এমন একটি জায়গায় নিয়া গেল,যেখানে পানি ছিল না।পা পর্যন্ত একটু পানি ছিল,সেই পানি দিয়া ওজু করছি।দোয়া-দরুদ পড়ছি।শরীরে যে পোশাক ছিল,সেটা ভাইসা গেছে।পড়নে আমার শুধুমাত্র গেঞ্জি।গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁইধা নেই।আমি একটা রড ধইরা আছিলাম।এরপর আর কিছু জানি না।আমি হঠাৎ বুঝতে পারি,পানিতে ভাসতেছি। পরে আমারে উঠায়া নিয়ে আসে।’মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশীদ উন নবী বলেন,সুমন বেপারী প্রথম যখন আনা হয় তখন তার হালকা শ্বাসকষ্ট ছিল।তবে,এখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছে।চিকিৎসকদের বলে দেওয়া হয়েছে,প্রয়োজন বুঝে তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য।হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে,কোনো সমস্যা না থাকায় সুমন বেপারীকে যেকোনো সময় ছাড়পত্র দেওয়া হতে পারে।উল্লেখ্য,গত সোমবার সকালে শ্যামবাজার সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিং বার্ড লঞ্চডুবির ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ৩৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।তবে,সোমবার রাতে উদ্ধারকাজ চলার সময় অলৌকিকভাবে ভেসে ওঠেন সুমন বেপারী।ফায়ার সার্ভিস বলছে,লঞ্চ ডুবে যাওয়ার সময় ভিতরে জমে থাকা বাতাসের কারণে হয়তো প্রাণে বেঁচে গেছেন সুমন বেপারী।