
রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার গোল্লাপাড়া মহল্লার কৃষক নূর মোহাম্মদ। রাজশাহী অঞ্চলে তিনি একজন আদর্শ কৃষক হিসেবে পরিচিত। কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন স্বর্ণপদক।
চলতি রোপা আমন মৌসুমে বিলকুমারী বিলসংলগ্ন গোল্লাপাড়ায় এক একর জমিতে ৭৪ প্রকার জাতের ধান রোপণ করেছেন। তার উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের সংখ্যা দুই শতাধিক। এছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় ৩০০ জাতের ধানের বীজ তিনি সংরক্ষণে রেখেছেন।
বর্তমানে রোপণকৃত ক্ষেতজুড়ে শোভা পাচ্ছে ছোট ছোট অনেক সাইনবোর্ড। শুরুতেই যে কেউ দেখলে ভাববেন এটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের প্রদর্শনী প্লট। কিন্তু না, গোল্লাপাড়া মহল্লার প্রান্তিক কৃষক নূর মোহাম্মদের নিজস্ব ধান গবেষণা ক্ষেত।
কাছে গিয়ে দেখা যাবে- লাল, বেগুনি, সোনালি, সবুজ, খয়েরি, সাদাগুঁটিসহ নানা প্রকার ধানে ভরপুর পুরো ক্ষেত। কৃষক বাবার হাত ধরেই কৃষিতে হাতেখড়ি। এরপর দীর্ঘ গবেষণার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি সংকরায়ণের মাধ্যমে একের পর এক বিভিন্ন জাতের নতুন ধানের উদ্ভাবন করেছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন আরো গবেষণা। বছর বছর উদ্ভাবন করছেন নতুন ধানের বীজ। এ বছরও তিনি গবেষণার মাধ্যমে আরো একটি নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
আজন্ম কৃষক নূর মোহাম্মদের উদ্ভাবনকৃত নতুন জাতের ধানের সংখ্যা দুই শতাধিক। তার নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
নূর মোহাম্মদের উদ্ভাবনী ধান খরাসহিষ্ণু। নতুন উদ্ভাবনকৃত জাতের নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-১০৫ (নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিষেবা)। এ বছর তার নতুন উদ্ভাবনী ধান বোরো মৌসুমে বপন করা যাবে। এ জাতের ধান ১৩০ দিনের মধ্যেই কাটা যাবে। দেশের প্রচলিত বোরো ধান বপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত সময় লাগে ১৪০ দিন। তার নতুন এই জাতের ধান কৃষক ১০ দিন কম সময়ে ঘরে তুলতে পারবেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার নূর মোহাম্মদের ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রান্তিক কৃষক নূর মোহাম্মদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সনদ নেই। কিন্তু তার রয়েছে ধান নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা। স্বশিক্ষিত এই বিজ্ঞানীর কাজ আমলে নিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। সংকরায়ণ করে একের পর এক নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন এই প্রান্তিক কৃষক। তার উদ্ভাবনী বিভিন্ন ধানের জাত স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে।
এলাকার কৃষকরা বলছেন, নূর মোহাম্মদ দীর্ঘদিন থেকেই ধান নিয়ে গবেষণা করছেন। তার চিন্তা ও গবেষণায় একের পর এক নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। এসব জাতের ধান তিনি এ অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার উদ্ভাবনী ধান এখন অনেক কৃষক চাষাবাদ করছেন। এর ফলে কৃষকরা কম খরচে এবং কম সময়ে অধিক ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। এরই মধ্যেই তিনি রাজশাহী অঞ্চলসহ সারা দেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।
এছাড়া খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চলের বিলুপ্ত হওয়া প্রায় তিনশ’ জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণে রেখেছেন নূর মোহাম্মদ। বিলুপ্ত হতে চলা এসব ধান বীজ সংরক্ষণ এবং ধান নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে করতে তিনি হয়ে উঠেছেন ধান বীজ বিজ্ঞানী।
দরিদ্র এই আদর্শ কৃষক নূর মোহাম্মদ তার নিজের মাটির বাড়িকে বানিয়ে ফেলেছেন বিলুপ্ত প্রায় ধান বীজের গবেষণাগার।
স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, চলতি রোপা আমন মৌসুমে এক একর জমিতে ৭৪ জাতের ধান লাগিয়েছেন। সংকরায়ণের মাধ্যমে এবার নতুন প্রজাতির একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের (বিএডিসি) রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক দোলোয়ার হোসেন বলেন, ধান বীজ গবেষক নূর মোহাম্মদ দেশের সম্পদ ও গর্ব। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতের ধান নিয়ে তিনি কাজ করছেন। কৃষি বিভাগ সব সময়ই নূর মোহাম্মদকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। তার প্লট ধান বিজ্ঞানীদের পরিদর্শন করানো হয়েছে। অন্য বিজ্ঞানীরাও তার প্লট পরিদর্শনে আসার কথা রয়েছে। আশা করছি এই প্রান্তিক কৃষকের মাধ্যমে দেশি জাতের হারানো অনেক জাতের ধান ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।