
কোরআনে হাফেজ জাহরা হোসাইন- মাত্র ৩ বছর বয়সেই কোরআনের হাফেজ হয়েছে আজারবাইজানের ছোট্ট ফুটফুটে এক শিশু। তার নাম জাহরা। এতো অল্প বয়সেই পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ করে ফেলায় সে হচ্ছে ওই দেশের কনিষ্ঠ হাফেজ।
আমরা সবাই জানি, আল কোরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। অতএব, কিয়ামত পর্যন্ত একে অবিকৃত ও সুসংরক্ষিত রাখা হবে। এতে কোনো ধরনের বিকৃতি ঘটবে না, এখানে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। এটা এ কারণে নিশ্চিত হয়েছে যে কোরআন শরিফ সংরক্ষণের দায়িত্ব খোদ আল্লাহতায়ালা নিজের দায়িত্বে রেখে দিয়েছেন। তিনি আমাদের মতো মানুষের মাধ্যমেই এর সংরক্ষণ করবেন এবং তা করছেনও।
প্রতিদিন হাজার হাজার মাসুম বাচ্চা কোরআন শরিফের হাফেজ হচ্ছে। গোটা দুনিয়ার মুদ্রিত সব কোরআন একসঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে দিলেও লাখো হাফেজের কণ্ঠ থেকে অবিকৃত কোরআন শরিফের সুরেলা আওয়াজে মুখরিত হবে তামাম দুনিয়া। সত্যিই এটা এক বিরল বিষয়। এ ধরনের নজির অন্য কোনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না।
আল্লাহতায়ালা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষণের এ ব্যবস্থাপনার নজির বিশ্ববাসী প্রায়ই দেখে। তেমনি এক অনন্য উদাহরণ আজারবাইজানের তিন বছর বয়সী ফুটফুটে মেয়ে ‘জাহরা হোসাইন’। এই বয়সেই সে পবিত্র কোরআনে কারিমের ৩৭টি সূরা মুখস্থ করে সেদেশের কনিষ্ঠ হাফেজ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বসবাসরত কনিষ্ঠ এই কোরআনের হাফেজ সম্পর্কে তার মা বলেছেন, ‘গর্ভকালীন সময়ে আমি প্রতিনিয়ত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতাম এবং উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াত মনোযোগ সহকারে শুনতাম।’ জাহরার মা আরও বলেন, ‘জাহরার জন্মের পর তার ঘুমের সময়ে ঘুমপাড়ানি ছড়ার জায়গায় আমি পবিত্র কোরআনের ছোট ছোট সূরাগুলো পড়তাম।
এভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু এক সময় আমি বুঝতে পারলাম, জাহরা মাত্র এক বছর বয়সেই আমার সাথে কোরআনের আয়াতগুলো পুনরাবৃত্তি করছে। আর এর ফলে তার জন্য কোরআনের অন্যান্য আয়াত ও সূরাগুলো আমি পড়তে আমি আগ্রহী হই। এভাবেই তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে জাহরা কোনো শিক্ষকের নিকট প্রশিক্ষণ ছাড়া ৩৭টি সূরা মুখস্থ করতে সক্ষম হয়েছে।’
জাহরার দাদা হাজী হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, ‘জাহরার কোরআন মুখস্থ করার জন্য তার মা’র ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কেননা, জাহরার জন্মের পূর্বে থেকেই তার মা সবসময় কোরআন তেলাওয়াত করত এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দানকৃত জাহরার এ প্রতিভার জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
তিনি আরও বলেন, জাহরার জন্মের পর থেকে তার ঘুম পাড়ানোর জন্য কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা হয়েছে এবং সে খুব মনোযোগ সহকারে শুনতো। এক বছর বয়সে জাহরা একা একাই সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস বলত।
জাহরার দাদা এ সাফল্যকে মহান আল্লাহর দান হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, এটা আল্লাহর করুণা যে, এক বছরের শিশু কোরআনের সূরা মুখস্থ করেছে। অথচ তার বয়সের অন্যান্য বাচ্চারা শুধুমাত্র ‘বাবা’ এবং ‘মা’ বলা শেখে। জাহরার বয়স যখন দু’বছর পূর্ণ হয় তখন সে কোরআনের ৮টি সূরা মুখস্থ করে এবং বর্তমানে তার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে এবং সে তাজবিদ সহকারে পবিত্র কোরআনের ৩৭টি সূরা মুখস্থ করতে সক্ষম হয়েছে।
জাহরার কুরআন মুখস্থে তার মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। কারণ তার জন্মের আগে থেকে মায়ের নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত এবং জন্মের পর ঘুম পাড়ানোর সময় কোরআনের অবিরাম তেলাওয়াতই জাহরাকে কুরআনের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে।
ইবাদত যে কারণে নষ্ট হয়….
মুমিন মুসলমান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কখনও কখনও অনেককেই ইবাদত-বন্দেগিতে অবহেলা করতে দেখা যায়। এটা যারা করে তারা মূলতঃ দুর্বল ঈমানের পরিচয় বহন করে। তাদের অন্তর ঈমানের তেজোদ্বীপ্ত আলোয় পাকাপোক্ত হয়নি। আর ইবাদত-বন্দেগিতে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
যেসব কারণে মানুষের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণ উল্লেখ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। কুরআনে এসেছে-
‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে আর যদি কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হয় তবে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই হলো তাদের সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১১)
একশ্রেণির লোক আছে, যারা ইসলাম গ্রহণের পর বা ইবাদত-বন্দেগি করার পর তাদের সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদে উন্নতি হয়, তাতে তারা আনন্দিত হয় এবং এটাকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করে। আবার যখন তারা কোনো বিপদ-আপদ ক্ষতি কিংবা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় তখন তারা বলে, ‘না’, এটাতো প্রকৃত ধর্ম নয়। এ শ্রেণির লোকেরাই ইবাদত-বন্দেগিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কারণ তারা ঈমান গ্রহণের পর বা ইসলামি নিয়মনীতি মেনে চলার যখন দুনিয়ার জীবনের সুখ-শান্তির খুঁজে পায় তখন তারা ঈমানের ওপর অটল হয়ে যায়। আর যদি পরীক্ষাস্বরূপ কোনো বিপদ-আপদ তাদের ওপর চলে আসে তবে তারা পেরেশানিতে পতিত হয়। আর এ পেরেশানি ও গড়িমসিই তাদের ইবাদতকে নষ্ট করে দেয়।
ইবাদত-বন্দেগিতে যারা অবহেলা বা গড়িমসি করে তাদের কঠোর আজাবের কথাও কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘অতএব দুর্ভোগ বা শাস্তি সেসব নামাজির জন্য যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বেখবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে থাকে।’ (সুরা মাউন : আয়াত ৪-৬)
এ আয়াতে নামাজে গড়িমসি বা অবহেলাকারীদের জন্য দুর্ভোগ বা শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অবহেলা বা গড়িমসি করে নামাজ পড়লে যদি শাস্তি বা দুর্ভোগ পোহাতে হয় তবে, সে ইবাদত বা নামাজ তো নষ্টেরই শামিল।
আল্লাহ তাআলা এ রকম দোদুল্যমান বান্দাদের সতর্ক করেছেন। মুমিন বান্দাকে আল্লাহ নেয়ামত দিয়ে এবং নেয়ামত নিয়ে পরীক্ষা করবেন। জীবনে উন্নতি দিয়ে যেমন পরীক্ষা করবেন আবার জান ও মালের ক্ষতি দিয়েও পরীক্ষা করবেন।
যারা জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বিপদ-আপদ, ধন-সম্পদের উন্নতি-অবনিত, সন্তান-সন্ততির বাড়তি-কমতি এমনকি হায়াত-মউতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তারাই ঈমানের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করবে। তাদের ইবাদত-বন্দেগি নষ্ট হবে না। তারাই প্রকৃত ঈমানদার।
দুনিয়ার জীবনের শুরুতে পড়া-লেখায় সফলতা-ব্যর্থতা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরিতে সচ্ছল-অসচ্ছল অবস্থা ইত্যাদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। এ জন্য নিজেকে সব সময় ঈমানের উপর অটল ও অবিচল রাখা জরুরি।
আর যারা দুনিয়ার সাময়িক জীবনে ক্ষতি ও বিপদে হতাশ হয়ে যায়। তাদের এ ক্ষতি শুধু দুনিয়ার নয় বরং তারা পরকালের জীবনকেও ধ্বং’স করে দেয়। আল্লাহর বিধিবিধান পালনে গড়িমসি ও অবহেলা করে তাদের দুনিয়া এবং পরকালের যাবতীয় কাজ নষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ সেই মহান সত্ত্বা তিনি যাকে ইচ্ছা যেমন সচ্ছল দিতে পারেন আবার যাকে ইচ্ছা তাকে দুর্ভোগ ও কষ্ট দিতে পারেন। এসবই মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। কুরআনুল কারিমের মহান আল্লাহ তাও তুলে ধরেছেন-
‘বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী।
তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।’ (সুরা ইমরান : আয়াত ২৬)
সুতরাং নামাজসহ সব ইবাদত হৃদয় ও প্রাণ উজাড় করে দিয়ে করতে হবে। আল্লাহর বিধিবিধান যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। কোনোভাবেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মন নিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করা যাবে না। ইবাদতে অবহেলা বা গড়িমসিও করা যাবে না। কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে ইবাদতে অবহেলা ও গড়িমসি করলে মানুষের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এমন বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন, যাতে সে সুখে-দুঃখে, উন্নতি-অবনতি সর্বাবস্থায় সমান উৎসাহ উদ্দীপনায় ইবাদত করার হিম্মত পায়। যেন কোনোভাবেই ইবাদত বন্দেগি নষ্ট হয়ে না যায়। বরং কুরআনুল কারিমের সুরা হজের ১১ নং আয়াতকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে দ্বিধা-দ্বন্দ্বমুক্ত ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।